সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা

Home / Book Review / সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা

 বইয়ের নামঃ সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা

লেখকঃ লে জেনারেল যে এফ আর জেকব

বই নং -১৫৮২

অনির্বাণ পাঠাগার 

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জেকবের লেখা এই বইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণ এবং দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর ভুমিকা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ের শুরুতে জেকব তার সৈনিক জীবনের ব্যক্তিগত পরিচিতি দিয়ে আরম্ভ করেন। ১৯৪১ সালে পলাশী গেট থেকে শুরু হওয়া আর্টিলারি অফিসার জেকবের সৈনিক জীবন শেষ হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসাবে ১৯৭৮ সালে।১৯৬৯ সালে ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্ব প্রাপ্ত জ্যাকব তৎকালীন পূর্ব  পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা নিবিড় ভাবে পর্যালোচনা করছিলেন । একাত্তরে ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানী সেনারা গণহত্যা চালায় তার পরপরই এপ্রিল মাসে ভারতীয় সরকারের সম্মতিতে সেনাপ্রধান মনেকশ ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্ব প্রাপ্ত জেকবকে নির্দেশ দেন পূর্বপাকিস্তানে আক্রমণের জন্য কিন্তু জেকব এই অভিযানের সীমাবদ্ধতা ও সক্ষমতা বিবেচনা করে তাৎক্ষনিক অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকার প্রস্তাব দেন এবং সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আক্রমণের জন্য জেকব নভেম্বর পর্যন্ত সময় চান। সেনাপ্রধান মনেকশ এই মতামতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি বিএসএফের পরিচালক জেনারেল রুস্তমজীকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন । জেনারেল রুস্তমজী নির্দেশ অনুযায়ী আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং জেকবের আশঙ্কা অনুযায়ী ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসেন এবং ছয় জন সদস্য পাকিস্তানীদের হাতে বন্দি হয়। পরবর্তীতে জেনারেল অরোরাকে চিফ করে জেকবকে কমান্ডার করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। জেনারেল জেকব যখন প্রস্তুতি পর্ব শুরু করেন তার পরিকল্পনায় ছিল বাংলাদেশের ভু-রাজনৈতিক গঠন, আবহাওয়া, পাকিস্তানী বাহিনীর সামর্থ্য বিচার, নিজেদের রসদ, চীনের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কা এবং মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা ইত্যাদি। ভূপ্রকৃতির কারণে তিনি আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রচুর ব্রিজ নির্মাণ সামগ্রী, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রসদ পৌঁছানোর জন্য প্রচুর রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করেন। সত্তরের দশকে এই আক্রমণের জন্য ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাংশের অবকাঠামোতে প্রচুর পরিবর্তন করতে হয়। যার জন্য ভারতীয় বাহিনী মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। একই সঙ্গে ভারতীয়দের মোকাবেলা করতে হয়েছে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির সাথে বিশেষ করে নদীমাতৃক বাংলাদেশে ভারী অস্র বহনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্রিজ তৈরির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, তার সাথে যোগ হয় বর্ষা ঋতুর চরম বৈরী পরিবেশ। এই পরিবেশ মোকাবেলায় যথাযথ সহায়তা করে মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানীদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পালন করে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। আক্রমণের ক্ষেত্রে জেনারেল জেকবের পরিকল্পনা ছিলো সম্ভাব্য সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্র এড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করা এবং পাকিস্তানীদের বিভিন্ন অংশের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রসদ পৌঁছাতে বাঁধা প্রদান করা এবং সরাসরি ঢাকা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। আক্রমণের জন্য পুরো এলাকাকে কয়েকটি সেক্টরে বিভক্ত করেন। যুদ্ধ শুরু হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখা দেয় চীন এবং মার্কিনদের অবস্থান। যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ভালো হওয়ার সাথে সাথে জেকব আত্মসমর্পণের শর্ত তৈরি করেন এবং কেন্দ্রে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করেন। যদিও কেন্দ্র ঢাকা আক্রমণের তুলনায় বেশি সংখক স্থান দখল করে মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি স্বাধীন এলাকা তৈরির দিকে বেশি নজর দেন। ফলে তারা ঢাকা আক্রমণের চেয়ে কুমিল্লা, খুলনা, সিলেট সীমান্তবর্তী এলাকা দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। জেনারেল জেকব কেন্দ্রের সাথে আলোচনা করে নিজের পরিকল্পনার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন এবং দ্রুত ঢাকা আক্রমণ করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন অন্যদিকে কেন্দ্রের লক্ষ্য ছিল জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও যেন মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যায় পাকিস্তানের ভিতর। একদিকে জাতিসংঘে মার্কিন-চীন বিরোধিতা অন্যদিকে নিজ কমান্ডারের যুদ্ধ কৌশলের উপর ভরসা এই দোলাচলে জেনারেল জেকবকে দুই দিনের সময় দেয়া হয় তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং একই সাথে কেন্দ্রের লক্ষ্যকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনার কথা বলা হয় যাতে যুদ্ধবিরতি হলেও মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি স্বাধীন অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যায়। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ বিকাল থেকে ১৬ তারিখ বিকেল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। জেনারেল জেকবের উপর নির্দেশ আসে পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর যদিও তখন পর্যন্ত তার প্রেরিত খসড়াটি অনুমোদন হয়নি। তিনি জেনারেল নিয়াজির সাথে তার খসড়াটি নিয়ে আলোচনা করেন এবং চাচ্ছিলেন তার খসড়াটির যেন বড় পরিবর্তন না করা হয়। জেনারেল নিয়াজি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিলেন তাই আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে তিনি প্রতিবাদ করেন। যদিও তখন তার প্রতিবাদ করার অবস্থান ছিলও না কারণ মিত্রবাহিনী বিভিন্ন অংশে দখল প্রতিষ্ঠার খবর কেন্দ্রে আসছিলো। আত্মসমর্পণ না করলে পাকিস্তানী একলক্ষ সৈনিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ফলে আত্মসমর্পণের বিকল্প ছিলও না জেনারেল নিয়াজির হাতে। তাকে সৈন্যদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার পর তিনি ১৬ তারিখ বিকালে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় একটি নতুন দেশ বাংলাদেশ।

Leave a Comment